প্রতিদিন আমাদের শরীরে অনেক রকম ভিটামিনের প্রয়োজন তার মধ্যে সবথেকে বেশি প্রয়োজন ভিটামিন সি-এর। ভিটামিন সি [C] যাকে আমরা অ্যাসকরবিক অ্যাসিড বলে থাকি সব থেকে বেশি প্রয়োজন আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বা ইমিউনিটি সিস্টেম কে উন্নত করতে।
ভিটামিন সি [C] আমাদের জন্য খুবই শক্তিশালী একটি অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যা আমাদের শরীরে ফ্রি রেডিক্যাল কে কমাতে সাহায্য করে। যার ফলে আমাদের শরীরে বিভিন্ন কঠিন রোগ যেরকম ক্যান্সার, টিউমার ইত্যাদি হবার প্রবণতা কমে যায়। ভিটামিন সি আমাদেরকে সাহায্য করে বিভিন্ন ইনফেকশন বা সংক্রমণের সাথে লড়তে।
বিভিন্ন ঔষধ বা ভিটামিন সি [C] সাপ্লিমেন্ট বাজার বা মার্কেটে সব সময় পাওয়া যায় তবে আমরা চেষ্টা করব বিভিন্ন খাবারের মাধ্যমে আমাদের শরীরের ভিটামিন সি এর চাহিদা পূরণ করতে তাই আজ আমাদের আলোচ্য বিষয় ভিটামিন সি জাতীয় খাবার নিয়ে। তবে একটা কথা আমাদের সব সময় মাথায় রাখতে হবে যেসব খাবারে ভিটামিন সি এর পরিমাণ অনেক বেশি সেই খাদ্যগুলিকে অত্যাধিক তাপে রান্না করলে তা থেকে ভিটামিন সি [C] নষ্ট হয়ে যায়।
ভিটামিন সি জাতীয় খাবার কি কি ?
ভিটামিন সি জাতীয় খাবারের তালিকা কে আমরা দুই ভাগে ভাগ করেছি তার গুণগত মান এবং বৈশিষ্ট্যের উপর।
ভিটামিন সি [C] সমৃদ্ধ ফল :
বিভিন্ন ফল আছে যাদের মধ্যে ভিটামিন সি পাওয়া যায় তবে আমাদের আলোচনা সবথেকে বেশি পরিমাণ ভিটামিন সি বা টোটাল অ্যাসকরবিক অ্যাসিড যে ফলগুলিতে পাওয়া যায় তাদেরকে নিয়ে।
ভিটামিন সি [C] সমৃদ্ধ ফল | ||
১০০ গ্রাম | পেয়ারার মধ্যে | ২২৮ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি |
১০০ গ্রাম | কমলা লেবুর মধ্যে | ৫৬.২ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি |
১০০ গ্রাম | পাকা পেঁপের মধ্যে | ৬০.৯ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি |
১০০ গ্রাম | পাতি লেবুর মধ্যে | ৫৩ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি |
১০০ গ্রাম | আমলকির মধ্যে | ৪৭৮ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি |
১০০ গ্রাম | আমের মধ্যে | ৩৬.৪ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি |
১০০ গ্রাম | স্ট্রবেরির মধ্যে | ৫৬ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি |
১০০ গ্রাম | আনারসের মধ্যে | ৪৭.৮ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি |
ভিটামিন সি [C] সমৃদ্ধ সবজি :
সাধারণত বেশিরভাগ সবজির মধ্যেই ভিটামিন সি পাওয়া যায়। তবে আমরা আলোচনা করছি সেই সমস্ত সবজি নিয়ে যাদের মধ্যে ভিটামিন সি এর পরিমাণ অনেক বেশি।
ভিটামিন সি [C] সমৃদ্ধ সবজি | ||
১০০ গ্রাম | ক্যাপসিকাম এর মধ্যে | ৮০.৪ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি |
১০০ গ্রাম | টমেটোর মধ্যে | ১৬.৩ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি |
১০০ গ্রাম | পালং শাকের মধ্যে | ২৬.৫ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি |
১০০ গ্রাম | ব্রোকলির মধ্যে | ৯১.৩ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি |
১০০ গ্রাম | বাঁধাকপির মধ্যে | ৩৬.৬ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি |
ভিটামিন সি এর উপকারিতা ও অপকারিতা :
শুধুমাত্র ভিটামিন সি [C] জাতীয় খাবার গ্রহণ করা আমাদের মূল লক্ষ্য নয়। আমাদের জানা উচিত ভিটামিন সি জাতীয় খাবার আমরা যদি নিয়মিত গ্রহণ করি তাহলে আমাদের শরীরে ভিটামিন সি এর উপকারিতা এবং অপকারিতা কি হতে পারে। ভিটামিন সি এর উপকারিতা আমাদের শরীরের জন্য অসামান্য তবে খুব বেশি ভিটামিন সি গ্রহণ করলে তার কিছু অপকারিতা বা পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া থাকতে পারে।
ভিটামিন সি জাতীয় খাবারের উপকারিতা :
- ভিটামিন সি [C] একটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যা আমাদের শরীরে ফ্রী রেডিকেল কে কমাতে সাহায্য করে। যার ফলে আমাদের কঠিন রোগ যেরকম ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়।
- যেহেতু ভিটামিন সি বা অ্যাসকরবিক অ্যাসিড একটি অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট তাই নিয়মিত ভিটামিন সি গ্রহণ করলে আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বা ইমিউনিটি সিস্টেম অনেক বেশি উন্নত হয়। বিভিন্ন সংক্রমণ বা ইনফেকশনের হাত থেকে আমরা রক্ষা পাই।
- আমাদের শরীরে রক্ত সঞ্চালনের জন্য ভিটামিন সি অনেক সাহায্য করে। আমাদের হৃদয় বা হার্ট থেকে ব্লাড ভেসেল গুলোকে শরীরের প্রতিটি অঙ্গে পৌঁছাতে সাহায্য করে। তাই নিয়মিত ভিটামিন সি গ্রহণ করলে আমাদের ব্লাড প্রেসার বা রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে এবং হাই ব্লাড প্রেসার হবার প্রবণতা অনেক কমে যায়।
- প্রতিদিন ভিটামিন সি জাতীয় খাবার গ্রহণ করলে আমাদের শরীরে এল ডি এল(LDL) ব্যাড কোলেস্টেরল এর পরিমাণ কমতে থাকে এবং এইচ ডি এল (HDL) গুড কোলেস্টেরলের পরিমাণ বাড়তে থাকে। যার ফলে আমাদের হৃদয় বা হার্ট সংক্রান্ত রোগ হওয়ার প্রবণতা কমে যায়।
- যদি আমাদের শরীরে ইউরিক অ্যাসিড বেড়ে যায় তাহলে আমাদের শরীরের বিভিন্ন অংশে ব্যথা বা যন্ত্রণার সৃষ্টি হয়। কিন্তু আমরা যদি নিয়মিত ভিটামিন সি জাতীয় খাবার গ্রহণ করি তাহলে আমাদের ইউরিক অ্যাসিড অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে থাকে এবং আমাদের শরীরের বিভিন্ন অংশে ব্যথা বা যন্ত্রণার প্রবণতা কমে যায়।
- আমাদের শরীর ভিটামিন সি ছাড়া কোলাজেন নামক এক প্রোটিন উৎপন্ন করতে পারেনা। এই কোলাজেন আমাদের শরীরের হাড়, পেশী, মাংস এমনকি ত্বক বা স্কিন তৈরি করতে অনেক সাহায্য করে। তাই আমাদের শারীরিক গঠন সঠিক রাখতে প্রতিদিন ভিটামিন সি জাতীয় খাদ্য গ্রহণ করা খুবই প্রয়োজন।
- ভিটামিন সি আমাদের ত্বক বা স্কিন এবং চুলের জন্য খুবই প্রয়োজনীয় একটি উপাদান। নিয়মিত পর্যাপ্ত পরিমাণ ভিটামিন সি যুক্ত খাদ্য গ্রহণ করলে আমাদের ত্বক এবং চুলে কোনরকম ইনফেকশন বা সংক্রমণ হবার প্রবণতা থাকে না। এছাড়াও ভিটামিন সি এর মধ্যে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকার ফলে আমাদের ত্বক এবং চুল ভালো থাকে।
- পর্যাপ্ত পরিমাণ ভিটামিন সি গ্রহণ করলে আমাদের মস্তিষ্কের বিকাশ হয় যার ফলে আমাদের মানসিক চিন্তা অনেক নিয়ন্ত্রণে থাকে এবং আমাদের মেন্টাল হেলথ অনেক উন্নত হয়। যা আমাদের মনোবলকে বৃদ্ধি করতে অনেক সাহায্য করে।
- নিয়মিত ভিটামিন সি জাতীয় খাবার গ্রহণ করলে আমাদের শরীরে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এর পরিমাণ বাড়তে থাকে তার ফলে আমাদের শরীর থেকে টক্সিক জাতীয় পদার্থ বেরিয়ে যায়। আমাদের চোখ সম্পর্কিত রোগ হওয়ার প্রবণতা কমে যায় এবং আমাদের ঠান্ডা, কাশি, কফ এবং জ্বর হওয়ার প্রবণতা কমে যায়।
ভিটামিন সি জাতীয় খাবারের অপকারিতা :
ভিটামিন সি [C] জলে দ্রাব্য যার ফলে আমাদের শরীরে অপ্রয়োজনীয় ভিটামিন সি [C] রেচন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শরীর থেকে বের হয়ে যায় তাই সাধারণত ভিটামিন সি এর অপকারিতা বা পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া খুবই কম। তবে খুব বেশি পরিমাণ ভিটামিন সি গ্রহণ করলে কিছু পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া দেখা যায় যেরকম,
- খুব বেশি পরিমাণ ভিটামিন সি জাতীয় খাদ্য গ্রহণ করলে আমাদের হজম শক্তিতে সামান্য সমস্যা দেখা দিতে পারে।
- শুধু তাই নয় যাদের প্রথম থেকে অ্যাসিডিটি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে তাদের অ্যাসিডিটি হওয়ার প্রবণতা বেড়ে যায়।
- এমনকি খুব বেশি পরিমাণ ভিটামিন সি জাতীয় খাবার গ্রহণ করলে আমাদের ডায়রিয়া হবার সম্ভাবনা থাকে।
- খুব বেশি ভিটামিন সি জাতীয় খাবার গ্রহণ করলে বমি ভাব হবার প্রবণতা বেড়ে যায়। মাথা যন্ত্রণা এবং অনিদ্রা হবার প্রবণতা বৃদ্ধি পায়।
প্রতিদিন কতটুকু ভিটামিন সি খাওয়া উচিত ?
প্রতিদিন কতটা ভিটামিন সি খাওয়া উচিত সেটি সম্পূর্ণ নির্ভরশীল প্রতিটি মানুষের শারীরিক গঠনের উপর। তবে একটা সাধারণ পরিমাপ নিচে উল্লেখ করা হলো,
- ৮০ – ৯০ মিলিগ্রাম একটি প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের জন্য,
- ৭০ – ৭৫ মিলিগ্রাম একটি প্রাপ্তবয়স্ক মহিলার জন্য,
- ৮০ – ৮৫ মিলিগ্রাম একটি গর্ভবতী মায়ের জন্য,
বাচ্চা এবং ছোটদের জন্য ভিটামিন সি এর পরিমাণ প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় অনেকটাই কম। তবে বিভিন্ন কারণে ভিটামিন সি গ্রহণের পরিমাণ কম বেশি হতে পারে যেরকম, আমরা যদি কোন কারণে অসুস্থ হয়ে পড়ি তাহলে আমাদের শরীরে ভিটামিন সি এর প্রয়োজন অনেক বেশি থাকে।
ভিটামিন সি এর অভাবে কি হয় ?
ভিটামিন সি [C] এর অভাবে আমাদের মধ্যে নানান ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে যেরকম,
- ভিটামিন সি এর অভাবে আমাদের শরীরে পর্যাপ্ত পরিমাণ অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট উপাদান পৌঁছাতে পারেনা যার ফলে আমাদের ইমিউনিটি সিস্টেম বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমতে থাকে এবং আমাদের মধ্যে বিভিন্ন রকমের ইনফেকশন বা সংক্রমণ হবার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়। ঠান্ডা, কাশি, জ্বর ইত্যাদি হবার প্রবণতা ও বৃদ্ধি পায়।
- আমাদের শরীরের হাড় শক্ত করতে এবং শারীরিক গঠন ঠিক রাখতে ভিটামিন সি এর অনেক বেশি প্রয়োজন। তাই ভিটামিন সি এর অভাবে আমাদের হাড়ের ক্ষয় হয় এবং হাড় ভেঙে যাওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়।
- ভিটামিন সি আমাদের শরীরের বিভিন্ন পেশী তৈরি করতে সাহায্য করে তাই ভিটামিন সি এর অভাব হলে আমাদের শরীরের বিভিন্ন জয়েন্ট যেরকম কোমর, হাঁটু, ঘাড় ইত্যাদিতে ব্যথা বা যন্ত্রণা হওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পায়।
- ভিটামিন সি আমাদের ত্বককে অক্সিডেটিভ ড্যামেজ এর হাত থেকে রক্ষা করে। তাই ভিটামিন সি এর অভাবে আমাদের ত্বক অনেক বেশি রুক্ষ এবং শুষ্ক হয়ে পড়ে। যার ফলে আমাদের ত্বকের উপর বিভিন্ন ইনফেকশন বা সংক্রমণ হওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পায়।
- আমাদের মাথার ত্বকে অবস্থিত ফলিকল গুলিতে ভিটামিন সি এর খুবই প্রয়োজন। সঠিকভাবে আমাদের চুলকে উৎপন্ন করতে এবং রক্ষণাবেক্ষণ করতে সাহায্য করে। তাই ভিটামিন সি এর অভাবে আমাদের চুল উঠে যাওয়ার এবং শুষ্ক বা রুক্ষ হওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পায়।
- আমাদের শরীরে ভিটামিন সি এর অভাব হলে আয়রন শোষন করার ক্ষমতা নষ্ট হয় যার ফলে আমাদের শরীরে আয়রন ডেফিসিয়েন্সি দেখা দিতে পারে। ফলস্বরূপ পরবর্তীকালে আমাদের মধ্যে অ্যানিমিয়া বা রক্তশূন্যতা হবার প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। শুধু তাই নয় ভিটামিন সি এর অভাবে আমাদের রক্তক্ষরণ বৃদ্ধি পায় যার ফলেও আমাদের শরীরের রক্তের পরিমাণ কমতে থাকে।
প্রশ্ন উত্তর :
সবচেয়ে বেশি ভিটামিন সি সমৃদ্ধ ফল কি?
অস্ট্রেলিয়া দেশে এক প্রকার ফল পাওয়া যায় যার নাম কাকাডু প্লাম। ১০০ গ্রাম কাকাডু প্লাম ফলের মধ্যে ২৯০৭ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি বা অ্যাসকরবিক অ্যাসিড পাওয়া যায়। তবে আমাদের এশিয়ার মহাদেশে বিভিন্ন দেশগুলোতে অনেক ফল পাওয়া যায় যার মধ্যে ভিটামিন সি এর পরিমাণ অনেক বেশি। যেরকম আমলকি, পাতি লেবু, কমললেবু, কামরাঙ্গা বা স্টার ফ্রুট, আনারস ইত্যাদি।
একটি লেবুতে কি পরিমান ভিটামিন সি থাকে ?
লেবু বিভিন্ন ধরনের হয় যেরকম পাতি লেবু, কমলালেবু, মৌসম্বি লেবু ইত্যাদি এবং প্রতিটি লেবুতে ভিটামিন সি এর পরিমাণ ভিন্ন রকমের। তবে এটা সঠিক বেশিরভাগ লেবুতেই ভিটামিন সি এর পরিমাণ অনেক বেশি। যেরকম, ১০০ গ্রাম কমলা লেবুতে ভিটামিন সি এর পরিমাণ ৫৬.২ মিলিগ্রাম। আবার ১০০ গ্রাম পাতি লেবুতে ভিটামিন সি এর পরিমাণ ৫৩ মিলিগ্রাম।
বিশেষ দ্রষ্টব্য : উপরে উল্লেখিত বিষয়গুলি ব্যবহারের পূর্বে অবশ্যই একবার আপনার ডক্টরের সাথে পরামর্শ করে নেবেন।