ভিটামিন কে (K) এর মুখ্য কাজ আমাদের রক্ত তঞ্চনে সহায়তা করা যার ফলে আমাদের শরীরে খুব বেশি রক্তক্ষরণ হবার প্রবণতা কমে যায়। এছাড়াও ভিটামিন কে সাহায্য করে আমাদের শরীরের হাড় এবং শারীরিক গঠনকে উন্নত করতে।
শুধু তাই নয়, ভিটামিন কে এর কাজ আমাদের যকৃত, মস্তিষ্ক এবং হৃদয় কে সঠিকভাবে চালনা করতে সহায়তা করা। ভিটামিন কে খুব সহজে ভেঙে যায় এবং আমাদের রেচন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শরীর থেকে বের হয়ে যায়।
যেহেতু ভিটামিন কে (K) খুব সহজেই রেচন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আমাদের শরীর থেকে বের হয়ে যায় তাই প্রতিনিয়ত পর্যাপ্ত পরিমাণ ভিটামিন কে জাতীয় খাবার গ্রহণ করা আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই আজ আমাদের আলোচ্য বিষয় ভিটামিন কে জাতীয় খাবার সম্পর্কে।
ভিটামিন কে এর রাসায়নিক নাম কি ?
ভিটামিন কে এর রাসায়নিক নাম ফাইটোনাডিওন এবং ভিটামিন কে (K) তেলে দ্রাব্য বা ফ্যাট সলিউবল। মূলত ভিটামিন কে এর দুইটি রূপ আছে, ভিটামিন K১ (ফাইলোকুইনোন) যা আমরা বিভিন্ন সবুজ শাক সবজি থেকে পেয়ে থাকি, এবং ভিটামিন K২ (মেনাকুইনোন) যা আমরা মাংস, দুগ্ধজাত খাদ্য দ্রব্য, ডিম এবং আমাদের শরীরে উপস্থিত ব্যাকটেরিয়া থেকে পেয়ে থাকি।
ভিটামিন কে জাতীয় খাবারের তালিকা :
সাধারণত সবুজ রঙের শাকসবজি, কম বেশি ভিটামিন কে এর উৎস। তবে আমরা উল্লেখ করেছি সেই সব খাদ্যগুলিকে যেগুলির মধ্যে ভিটামিন কে সব থেকে বেশি পরিমাণ পাওয়া যায়। আমরা ভিটামিন কে জাতীয় খাবার গুলির বৈশিষ্ট্য এবং পরিমাণের উপর নির্ভর করে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছি।
ভিটামিন কে জাতীয় সবজি :
ভিটামিন কে সব থেকে বেশি পরিমাণ পাওয়া যায় বিভিন্ন শাক এবং সবজির মধ্যে। এই সবজিগুলি খুব সহজেই আমরা বাজার বা মার্কেট থেকে সংগ্রহ করতে পারি।
১০০ গ্রাম পালং শাকের মধ্যে | ৪৮৩ মাইক্রোগ্রাম ভিটামিন কে পাওয়া যায় |
১০০ গ্রাম বাঁধাকপির মধ্যে | ৭৬ মাইক্রোগ্রাম ভিটামিন কে পাওয়া যায় |
১০০ গ্রাম বিনস এর মধ্যে | ৪৩ মাইক্রোগ্রাম ভিটামিন কে পাওয়া যায়। |
১০০ গ্রাম ফুলকপির মধ্যে | ১৫.৫ মাইক্রোগ্রাম ভিটামিন কে পাওয়া যায় |
১০০ গ্রাম ব্রকলির মধ্যে | ১০২ মাইক্রোগ্রাম ভিটামিন কে পাওয়া যায় |
১০০ গ্রাম লেটুস পাতার মধ্যে | ৭৫ মাইক্রোগ্রাম ভিটামিন কে পাওয়া যায় |
১০০ গ্রাম কুমড়োর মধ্যে | ৭.৬ মাইক্রোগ্রাম ভিটামিন কে পাওয়া যায়। |
১০০ গ্রাম টমেটোর মধ্যে | ৭.৫ মাইক্রোগ্রাম ভিটামিন কে পাওয়া যায় |
ভিটামিন কে জাতীয় ফল :
যদিও আমাদের এশিয়া মহাদেশের বিভিন্ন দেশ গুলিতে প্রচুর পরিমাণ ফল পাওয়া যায়। তার মধ্যে বিশেষ কিছু ফলের মধ্যে খুবই সামান্য পরিমাণ ভিটামিন কে পাওয়া যায় যেরকম,
১০০ গ্রাম ডুমুর ফলের মধ্যে | ৪.৭ মাইক্রোগ্রাম ভিটামিন কে পাওয়া যায় |
১০০ গ্রাম খেজুরের মধ্যে | ২.৭ মাইক্রোগ্রাম ভিটামিন কে পাওয়া যায় |
১০০ গ্রাম পেয়ারার মধ্যে | ২.৬ মাইক্রোগ্রাম ভিটামিন কে পাওয়া যায় |
১০০ গ্রাম আপেলের মধ্যে | ২.২ মাইক্রোগ্রাম ভিটামিন কে পাওয়া যায় |
১০০ গ্রাম পাকা পেঁপের মধ্যে | ২.৬ মাইক্রোগ্রাম ভিটামিন কে পাওয়া যায় |
ভিটামিন কে সমৃদ্ধ অন্যান্য খাদ্য :
সব থেকে বেশি পরিমাণ ভিটামিন কে (K) সয়াবিন তেলের মধ্যে পাওয়া যায়।
- ১০০ গ্রাম সয়াবিন তেলের মধ্যে ১৮৪ মাইক্রোগ্রাম ভিটামিন কে পাওয়া যায়।
এছাড়াও বিভিন্ন খাদ্যের মধ্যে ভিটামিন কে পাওয়া যায় যেরকম,
- ডিম, মাছ, মাংস
- বিভিন্ন প্রকারের বাদাম যেরকম চিনা বাদাম, কাজু, পেস্তাবাদাম
- বিভিন্ন দুগ্ধজাত দ্রব্যের মধ্যে ভিটামিন কে পাওয়া যায় যেরকম মাখন বা বাটার, পনির, ঘি ইত্যাদি।
ভিটামিন কে এর উপকারিতা কি ?
- যদি কোন দুর্ঘটনার কারণে আমাদের রক্তক্ষরণ হয় সেই ক্ষেত্রে ভিটামিন কে সাহায্য করে আমাদের রক্ত তঞ্চনে। তাই ভিটামিন কে এর মুখ্য কাজ আমাদের রক্ত তঞ্চনে সহায়তা করা এবং আমাদের রক্তক্ষরণের প্রবণতা কম করা।
- ভিটামিন ডি এর মত ভিটামিন কে ও পরোক্ষভাবে সাহায্য করে আমাদের শরীরের হাড় এবং দাঁত কে আরো বেশি শক্ত এবং দৃঢ় করতে। তাই নিয়মিত ভিটামিন কে জাতীয় খাবার গ্রহণ করলে আমাদের শরীরের হাড় এবং গঠন অনেক উন্নত হয়।
- আমাদের বয়স বেড়ে যাওয়ার সাথে সাথে স্মৃতিশক্তি কমতে থাকে এবং এটি খুব স্বাভাবিক। তবে বিভিন্ন পরীক্ষায় দেখা গেছে নিয়মিত ভিটামিন কে জাতীয় খাবার গ্রহণ করলে আমাদের শরীরে ভিটামিন কে পর্যাপ্ত পরিমাণে থাকে যার ফলে আমাদের স্মৃতিশক্তি অনেক উন্নত হয় এবং চিন্তাশক্তির বিকাশ হয়।
- নিয়মিত ভিটামিন কে গ্রহণ করলে আমাদের রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ থাকে যার ফলে আমাদের হৃদয়ের স্পন্দন ও নিয়ন্ত্রণ থাকে। যার ফলে আমাদের হৃদয় সংক্রান্ত রোগ হওয়ার প্রবণতা কমতে থাকে। শুধু তাই নয় আমাদের রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ থাকলে আমাদের মধ্যে বিভিন্ন রোগ হওয়ার প্রবণতা কমে যায় যেরকম স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাক।
- অনেক সময় আমাদের যকৃত বা লিভার এ বিভিন্ন রকমের ইনফেকশন যেরকম হেপাটাইটিস বি, হেপাটাইটিস সি এবং কঠিন রোগ লিভার ক্যান্সার ও দেখা দেয় যার ফলে মানুষের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা কমে যায়। তবে পরীক্ষায় দেখা গেছে ভিটামিন K২ প্রতিদিন গ্রহণ করলে আমাদের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়। শুধু তাই নয় নিয়মিত ভিটামিন কে জাতীয় খাবার গ্রহণ করলে আমাদের যকৃত বা লিভার সংক্রান্ত সমস্যা হওয়ার প্রবণতা অনেক কমে যায়।
- ভিটামিন কে সাহায্য করে আমাদের ইনসুলিন এর সেনসিটিভিটি বা সংবেদনশীলতা বৃদ্ধি করতে। আমাদের ইনসুলিনের সংবেদনশীলতা বৃদ্ধি হলে আমাদের রক্তে গ্লুকোজ এর পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ থাকে। যার ফলে আমাদের ব্লাড সুগার হওয়ার প্রবণতা কমে যায়।
ভিটামিন কে এর অভাবে কি হয় ?
সাধারণত একটি প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ এবং মহিলাদের মধ্যে ভিটামিন কে এর অভাব লক্ষ্য করা যায় না তার কারণ আমরা প্রতিদিন বিভিন্ন খাদ্য গ্রহণের মাধ্যমে ভিটামিন কে এর চাহিদা পূরণ করে থাকি। তবে নবজাতক শিশুর ক্ষেত্রে ভিটামিন কে এর ভূমিকা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। নবজাতক শিশুদের ভিটামিন কে এর ইনজেকশন দেওয়া হয় যাতে তাদের শরীরে ভিটামিন কে এর অভাব না হয়।
- ভিটামিন কে এর অভাবে আমাদের শরীরে রক্তক্ষরণের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। তার কারণ ভিটামিন কে সাহায্য করে আমাদের রক্ত কে জমাট বাঁধতে বা রক্ত তঞ্চনে। তাই কোন ক্ষতস্থানে যদি সঠিক সময়ের মধ্যে রক্ত জমাট বাঁধতে না পারে তাহলে আমাদের শরীর থেকে অনেক বেশি রক্ত বের হয়ে যাবে।
- ভিটামিন কে এর অভাবে আমাদের ডাইজেস্টিভ সিস্টেম বা হজম ক্ষমতা কমতে থাকে। এমনকি নানান ধরনের পেটের সমস্যা দেখা দেয় যেরকম, পেটে ব্যথা, পেটে বিভিন্ন প্রকারের ইনফেকশন ইত্যাদি।
- ভিটামিন কে আমাদের শরীরের হাড় এবং দাঁতের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান। ভিটামিন কে এর অভাবে আমাদের হাড় এবং দাঁতের আকার সর্বোচ্চ পরিমাণ উন্নত হয়ে উঠতে পারে না। এমনকি ভিটামিন কে এর অভাবে আমাদের মুখের ভেতর এবং দাঁতের গোড়াতে রক্তপাত হওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পায়।
- ভিটামিন কে সহায়তা করে আমাদের হৃদয়ের কার্যকারিতা বৃদ্ধি করতে এবং আমাদের হৃদয় সংক্রান্ত রোগ হবার প্রবণতা কে কম করতে তাই ভিটামিন কে এর অভাবে আমাদের হৃদয় সংক্রান্ত রোগ হবার প্রবণতা বৃদ্ধি পায়।
ভিটামিন কে (K) তেলে দ্রাব্য বা ফ্যাট সলিউবল এবং সাধারণত আমরা দুইটি রূপ পেয়ে থাকি ভিটামিন K১, ভিটামিন K২। ভিটামিন কে এর মুখ্য কাজ আমাদের রক্ত কে জমাট বাঁধতে বা রক্ত তঞ্চনে সাহায্য করা। এছাড়াও ভিটামিন কে আমাদের শরীরের হাড় এবং দাঁতের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ তার কারণ ভিটামিন কে সাহায্য করে আমাদের শরীরে পরোক্ষভাবে ক্যালসিয়াম কে শোষণ করতে। ভিটামিন কে আমাদের হৃদয়ের কার্যকারিতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে এবং হৃদয় সংক্রান্ত রোগ বা সমস্যা হবার প্রবণতাকে কম করে।
প্রতিদিন কতটা ভিটামিন কে গ্রহণ করা উচিত?
- একটি প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের প্রতিদিন ১০০ থেকে ১২০ মাইক্রোগ্রাম ভিটামিন কে গ্রহণ করা উচিত।
- একটি প্রাপ্তবয়স্ক মহিলার প্রতিদিন ৭৫ থেকে ৯০ মাইক্রোগ্রাম ভিটামিন কে গ্রহণ করা উচিত।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: উপরে উল্লেখিত খাদ্য গুলি গ্রহণের পূর্বে অবশ্যই একবার আপনার ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করে নেবেন।