সব থেকে বেশি মধু উৎপন্ন হয় চীন, টার্কি, কানাডা, আর্জেন্টিনা, ইরান এবং ইউনাইটেড স্টেট অফ আমেরিকাতে তবে প্রাকৃতিকভাবে মধু পাওয়া যায় আমাদের এশিয়ার বিভিন্ন দেশগুলোতে যেরকম ভারত ও বাংলাদেশ। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে মধু খাওয়ার উপকারিতা প্রচুর।
মধু খাওয়ার নিয়ম ও উপকারিতা পুরোপুরি নির্ভর করে তার গুণমান এবং তৈরি করার পদ্ধতির উপর। মধু বিভিন্ন প্রকারের হয় যেরকম প্রাকৃতিক মধু বা ন্যাচারাল হানি, নিম মধু, সরষে মধু, ইউক্যালিপটাস মধু ইত্যাদি।
এই মধুগুলো বানানোর পদ্ধতি টা একটু ভিন্নরকম, প্রথমে যে ধরনের মধু তৈরি করতে হবে তার আগে ওই ধরনের বাগান তৈরি করতে হয় তারপর তাতে বিভিন্ন পদ্ধতিতে মৌমাছি ছেড়ে ওই জাতীয় মধু তৈরি করা হয়। যেরকম সরষে মধু তৈরি করতে সরষের ক্ষেতে বা যেখানে সরষে চাষ হয় তার পাশে মৌমাছির বাক্স রাখা হয়। যাতে ওই মৌমাছি গুলি সর্ষে ফুলের মধু গ্রহণ করে সরষে মধু তৈরি করতে পারে।
সাধারণত আমাদের সবার বাড়িতে কমবেশি মধুর একটা কৌটো পাওয়া যায় কিন্তু আমাদের উচিত মধু সম্পর্কে সম্পূর্ণ জেনে তারপরই মধু গ্রহণ করা তাই আজ আমাদের আলোচ্য বিষয় মধু খাওয়ার উপকারিতা ও অপকারিতা নিয়ে।
আসুন আমরা আলোচনা করি যে ১০০ গ্রাম মধুতে কি আছে বা মধুর পুষ্টিগত গুনাগুন এবং নিউট্রিশন ফ্যাক্ট,
- ক্যালোরি ৩০৪
- প্রোটিন 0.3 গ্রাম
- কার্বোহাইড্রেট ৮২.৪ গ্রাম (ডায়াটেরি ফাইবার ০.২ গ্রাম)
- জল ১৭.১ গ্রাম
এছাড়াও আছে অনেক ভিটামিন এবং মিনারেল যেরকম,
- ভিটামিন C ০.৫ মিলিগ্রাম
- ভিটামিন B৬ ০.০২৪ মিলিগ্রাম
- ক্যালসিয়াম
- আয়রন
- ম্যাগনেসিয়াম
- ফসফরাস
- পটাশিয়াম
- সোডিয়াম
- জিংক
- কপার
- সেলেনিয়াম
- ম্যাঙ্গানিজ
মধু খাওয়ার উপকারিতা কি ?
- যখনই আমাদের আবহাওয়া পরিবর্তন হয় তখন প্রতিটা মানুষেরই একটা সাধারণ সমস্যা থাকে সেটি হলো ঠান্ডা লেগে যাওয়া, ভেতরে কফ জমে যাওয়া এবং শ্বাসে সমস্যা ইত্যাদি, এবং সেই সময় যদি আমরা নিয়মিতভাবে মধু গ্রহণ করি বা খেয়ে থাকি তাহলে আমাদের ওই জাতীয় সমস্যা আর হবে না তার কারণ মধুতে কিছু অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট উপাদান থাকে যেগুলি বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাস ঘটিত রোগের সাথে লড়তে পারে তাই নিয়মিত মধু খেলে আমাদের শ্বাসযন্ত্রে সংক্রমণ বা রেসপিরেটরি ইনফেকশন কম হয় এবং সর্দি কাশির জন্য মধু আদর্শ আয়ুর্বেদিক ঔষধ।
- যদি আমাদের শরীরে ফ্রি-রেডিকেল বাড়তে থাকে তাহলে অল্প অল্প করে আমাদের কোষ মরতে থাকে বা সেল ড্যামেজ হয় এবং আমাদের মধ্যে নানান ধরনের রোগ দেখা দেয় যেরকম নার্ভাস সিস্টেম ঘটিত, ক্যান্সার। তাই দৈনিক মধু খাওয়ার বিশেষ উপকারিতা রয়েছে আমাদের জন্য যেরকম, মধুর মধ্যে থাকে প্লান্ট কেমিক্যাল যেগুলি অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রূপে আমাদের শরীরে কাজ করে এবং শরীরের মধ্যে থাকা ফ্রি-রেডিকেল কে কম করে। মধুতে যে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট উপাদানগুলি রয়েছে সেগুলি আমাদের শরীরের জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ তার মধ্যে পরে ফাইটোকেমিক্যাল, ফ্লাবনইডস এবং অ্যাসকরবিক অ্যাসিড।
- অনেকক্ষণ পড়ে থাকা বা উন্মুক্ত রাখা খাবারে নানান রকম ব্যাকটেরিয়া বা ফাঙ্গাস আক্রমণ করে এবং সেই খাবার যদি আমরা ভুল করে খেয়েনি তাহলে সেই খাবার গুলি আমাদের পেটের মধ্যে গিয়ে আমাদের হজম শক্তি বা ডাইজেস্টিভ সিস্টেম কে খারাপ করে এবং আমাদের পেটে নানান সমস্যা যেরকম পেটে ব্যথা বা ডায়রিয়া জাতীয় রোগ দেখা দেয়। মধুতে কিছু অ্যান্টি ব্যাকটেরিয়াল বা অ্যান্টি ফাঙ্গাল উপাদান আছে যেগুলি ব্যাকটেরিয়া বা ফাঙ্গাল ইনফেকশন এর সাথে লড়ে এবং আমাদের পেটের সমস্যাকে ঠিক করে শুধু তাই না মধুতে প্রবায়োটিক উপাদান আছে যেগুলি আমাদের অন্ত্রের গুড ব্যাকটেরিয়াকে বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে যার ফলে নিয়মিত মধু গ্রহণ করলে আমাদের হজম ক্ষমতা অনেক বৃদ্ধি পায় এবং পেটের সমস্যা থেকে আমাদেরকে রক্ষা করে।
- মধুতে বিশেষ আন্টি-মাইক্রোবল, আন্টি-ফাঙ্গাল ও আন্টি-ব্যাকটেরিয়ার উপাদান রয়েছে যার মধ্যে থাকে হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড এবং গ্লুকোজ অক্সিডাইস যাদের পিএইচ (potential hydrogen) অনেক কম এবং যারা ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়া বা ফাঙ্গাল পুরোপুরি ধ্বংস করতে পারে, তাই আমাদের ক্ষতস্থানে বা ত্বকের উপর আমরা মধু লাগিয়ে থাকি। এছাড়াও যাদের গালে ব্রণ ও বা পিম্পলস থাকে তারা মধু সরাসরি ত্বকের উপর ব্যবহার করলে অনেক ভালো ফলাফল পেতে পারে।
- মধুতে থাকে ভিটামিন C, ভিটামিন B এবং প্রচুর মিনারেলস ও এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট উপাদান যা আমাদের শরীর কে বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাস ঘটিত রোগের সাথে লড়তে সাহায্য করে এবং আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বা ইমিউনিটি সিস্টেমকে অনেক উন্নত করে তাই আমরা মধুকে প্রাকৃতিক ঔষধ বলে থাকি।
- মধুতে থাকে পলিফেনালস যা আমাদের মাথার হিপোক্যাম্পাস অংশের যন্ত্রণাকে কমাতে পারে এবং আমাদের স্মৃতিশক্তিকে আরো উন্নত করতে পারে তাই নিয়মিত মধু খেলে বা গ্রহণ করলে আমাদের মাথা যন্ত্রণা কম হয় শুধু তাই না আমাদের মস্তিষ্কের বিকাশও খুব ভালো হয়।
- মধু খাওয়ার উপকারিতা আমাদের মুখের ভেতরের অংশের জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ তার কারণ মধুতে আছে কিছু অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল উপাদান যা আমাদের মুখের ভেতর বিভিন্ন ইনফেকশন বা মাউথ ইনফেকশন জনিত রোগ কে পুরোপুরি নির্মূল করে এবং ওই সমস্ত রোগ থেকে আমাদেরকে দূরে রাখে।
- সকালে ব্যায়াম বা এক্সারসাইজের পূর্বে উষ্ণ গরম জলের সাথে মধু মিশিয়ে আমরা খেতে পারি তার কারণ মধুতে থাকে প্রচুর ক্যালোরি, মিনারেল এবং ভিটামিন যা আমাদের শরীরের শক্তি বা এনার্জিকে অনেক বাড়িয়ে তোলে এবং আমাদের ব্যায়াম বা এক্সারসাইজের জন্য শক্তি বা এনার্জির যোগান দেয়।
মধু খাওয়ার সঠিক নিয়ম ও সময় কি ?
- সকালে উষ্ণ গরম জলে পাতিলেবুর সাথে এক চামচ মধু মিশিয়ে আমরা খেতে পারি আমাদের এক্সারসাইজ বা ব্যায়ামের পূর্বে।
- সকালে গ্রীন টি বা লিকার চায়ের সাথে সামান্য মধু মিশিয়ে আমরা খেতে পারি।
- দুপুরে লাঞ্চ বা খাবারের এক ঘন্টা পর আমরা সরাসরি এক চামচ মধু গ্রহণ করতে পারি বা খেতে পারি।
- রাতে ডিনারের এক ঘন্টা পর আমরা এক চামচ মধু সরাসরি গ্রহণ করতে বা খেতে পারি।
- এছাড়া যদি আমাদের শরীর খারাপ বা ঠান্ডা লেগে থাকে তাহলে উষ্ণ গরম জলে তুলসী পাতা এবং আদার সাথে এক চামচ মধু মিশিয়ে আমরা গ্রহণ করতে পারি।
মধু খাওয়ার অপকারিতা কি ?
- সব থেকে বড় ভুল আমাদের একদম ছোট বাচ্চাকে মধু খাওয়ানো। একদম ছোট বাচ্চাকে বা এক বছরের নিচের বাচ্চাকে একদমই মধু খাওয়ানো উচিত না তার কারণ মধুতে কিছু ব্যাকটেরিয়াল উপাদান রয়েছে যা, ওই ছোট বাচ্চার পেটের মধ্যে গিয়ে সামান্য পরিমাণ ক্ষতিকর জাতীয় পদার্থ বা টক্সিন্স উৎপন্ন করে।
- সাধারণভাবে মধু খাওয়া আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং উপকারী তবে কিছু মানুষের মধু খেলে শরীরে এলার্জির সমস্যা দেখা দিতে পারে।
- যদি আপনার প্রথম থেকে ব্লাড সুগারের সমস্যা হয়ে থাকে তাহলে বেশি পরিমাণ মধু গ্রহণ করলে বা খেলে আপনার শরীরের ইনসুলিনের ভারসাম্যতা হারাতে পারে এবং ব্লাড সুগারের মাত্রা বাড়তে পারে।
- আমাদেরকে বাজার বা মার্কেট থেকে এয়ার টাইট কাচের পাত্রে মধু কিনে আনার পর যত্ন সহকারে ব্যবহার করে, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন জায়গায় রেখে দিতে হবে যেখানে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে থাকে, না হলে মধুতে খুব দ্রুত ফাঙ্গাস বা ব্যাকটেরিয়া প্রভাব পড়ে এবং ওই মধু যদি আমরা গ্রহণ করি বা খেয়ে থাকি তাহলে আমাদের পেটে ব্যথা হয় এমনকি ডায়রিয়া ও হতে পারে।
বিশেষ দ্রষ্টব্য : মধু গ্রহণ করার পূর্বে অবশ্যই আপনার ডক্টরের সাথে আলোচনা করে নেবেন।